বারিমন্ডলের ধারণা
পৃথিবী পৃষ্ঠের ২৯.২% স্থলভূমি এবং ৭০.৮% জলভূমি। বিশাল জলরাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় থাকে যেমন- কঠিন (বরফ), গ্যাসীয় (জলীয়বাষ্প) এবং তরল। বায়ুমন্ডলে পানি রয়েছে জলীয়বাষ্প হিসেবে, ভূপৃষ্ঠে রয়েছে তরল ও কঠিন অবস্থায় এবং ভূপৃষ্ঠের তলদেশে রয়েছে ভূগর্ভস্থ তরল পানি। সুতরাং বারিমন্ডল (Hydrosphere) বলতে বোঝায় পৃথিবীর সকল জলরাশির অবস্থানভিত্তিক বিস্তরণ।
সমুদ্রস্রোত (Ocean Current)
সমুদ্রস্রোতের প্রধান কারণ বায়ুপ্রবাহ। বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগের পানির সঙ্গে ঘর্ষণ তৈরি করে এবং ঘর্ষণের জন্য পানিতে ঘূর্ণন তৈরি করে। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ করে চলাচল করে, এক সমুদ্রস্রোত বলে। সমুদ্রস্রোতকে উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- উষ্ণ স্রোত এবং শীতল স্রোত।
সমুদ্রস্রোতের কারণ
১) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ: নিযত বায়ুপ্রবাহই সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ। এসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোতের দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ুর প্রবাহ অনুযায়ী প্রধান সমুদ্রস্রোতগুলোর সৃষ্টি হয়। অয়ন বায়ু প্রবাহিত এলাকায় সমুদ্রস্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত এলাকায় সমুদ্রস্রোত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।
২) পৃথিবীর আহ্নিক গতি: পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রজলও উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
৩) সমুদ্রজলের তাপমাত্রার পার্থক্য: নিরক্ষীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় জলরাশি হালকা হয় ও হালকা জলরাশি সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্টপ্রবাহরূপে শীতল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে উষ্ণ স্রোত বলে। অন্যদিকে মেরু অঞ্চলের শতিল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমন্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে শীতল স্রোত বলে।
৪) মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফের গলন: মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফ কিছু পরিমাণ গলে গেলে জলরাশি স্ফীত হয় ও সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পরিমান হ্রাস পায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
৫) সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য: সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য অনুসারে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়। অগভীর সমুদ্রের জল দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরে ওঠে। তখন গভীরতর অংশের শতিল জল নিচে নেমে আসে। এজন্য ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠে গতি সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রের ১০০ মিটার নিচ থেকে গতি কমতে থাকে।
৬) সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পার্থক্য: সমুদ্রজলে লবণের সর্বত্র সমান নয়। অধিক লবণাক্ত জল বেশি ভারী বলে তার ঘণত্বও বেশি। বেশি ঘণত্বের জল কম ঘণত্বের দিকে প্রবাহিত হয় ও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে।
৭) ভূখন্ডের অবস্থান: সমুদ্রস্রোতের প্রবাহপথে কোনো মহাদেশ, দ্বীপ প্রভৃতি ভূখন্ড অবস্থান করলে সমুদ্রস্রোত তাতে বাধা পেয়ে দিক ও গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় এর প্রভাবে সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
জোয়ার – ভাটা (High Tide and Low Tide)
সমুদ্র এবং উপকূলবর্তী নদীর জলরাশি প্রতিদিনই কোনো একটি সময়ে ঐ জলরাশি ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে এবং কিছুক্ষণ পরে আবার তা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। জলরাশির এরকম নিয়মিত স্ফীতি বা ফুলে ওঠাকে জোয়ার বা নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। সমুদ্রের একই জায়গায় প্রতিদিন দুইবার জোয়ার ও দু’বার ভাটা হয়। উপকূলে কোন একটি স্থানে পর পর দুটি জোয়ার বা পর পর দুটি ভাটার মধ্যে ব্যবধান হলো ১২ ঘন্টা। প্রধানত দুটি কারণে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। ১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব ২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দাতিগ শক্তি।
(১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব: মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি প্রতিটি জ্যোতিষ্ক পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তাই এর প্রভাবে সূর্য চন্দ্র অপেক্ষা ২ কোটি ৬০ লক্ষ গুণ বড় হলেও পৃথিবী সূর্য হতে গড়ে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু পৃথিবী থেকে চন্দ্রের গড় দূরত্ব মাত্র ৩৮.৪ লক্ষ কিলোমিটার। এ কারণেই পৃথিবীর ওপর সূর্যের আকর্ষণ শক্তি চন্দ্র অপেক্ষা অনেক কম। ফলে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারে সূর্য অপেক্ষা চন্দ্রের প্রভাব বেশি। হিসাব করে দেখা গেছে যে, জোয়ার উৎপাদনে সূর্যের ক্ষমতা চন্দ্রের ৪৯ ভাগ। চাঁদ ও সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থিত হলে চাঁদ ও সূর্য উভয়ের আকর্ষণে জোয়ার অত্যন্ত প্রবল হয়।
(২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্রতিগ শক্তি: পৃথিবী নিজ মেরুরেখার চারদিকে অনবরত আবর্তন করে বলে কেন্দ্রিাতিগ শক্তি বা বিকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয়। এই কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অণুই মহাকর্ষ শক্তির বিপরীত দিকে বিকর্ষিত হয় বা ছিটকে যায়। তাই পৃথিবীর কেন্দাতিগ শক্তির প্রভাবে যেখানে মহাশক্তির প্রভাবে জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তার বিপরীত দিকে সমুদ্রের জল বিক্ষিপ্ত হয়েও জোয়ারের সৃষ্টি করে।
পরিবেশ দূশণ
মানুষের কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে পরিবেশের উপাদানে অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন হলো পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণ ৪ প্রকার। যথা- পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ এবং শব্ত দূষণ। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলো মানুষ।
বায়ুদূষণ: গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন মরনাক্সাইড গ্যাস থাকে। কার্বন মনোক্সাইড হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা খর্ব করে। ডিজেল পোড়ালে বাতাসে আসে সালফার-ডাই-অক্সাইড (SO2) গ্যাস। কলকারখানা অথবা যানবাহন হতে নির্গত কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড মূল ত বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। যান্ত্রিক পরিবহন ও শিল্পকারখানার দূষণ থেকে SMOG এর সৃষ্টি হয়। SMOG হচ্ছে এক ধরণের দূষিত বায়ু। স্মোগ (SMOG) শব্দটি এসেছে SMOKE + FOG হতে।
শব্দ দূষণ: শব্দ ১-৬০ ডেসিবল পর্যন্ত সহনীয়, ৬০-১০০ ডেসিবল পর্যন্ত বিরক্তিকর এবং ১০০-১৬০ ডেসিবল পর্যন্ত শ্রবণশক্তির জন্য ক্ষতিকর। শব্দ যদি একটি নির্দিষ্ট মাত্রা (৮০ ডেসিবল) ছাড়িয়ে যায় তখন তা দূষণের পর্যায়ে চলে আসে। শব্দ দূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা এবং চরম অবস্থায় মানসিক বৈকল্যের সুষ্টি হতে পারে। ১০৫ ডিবি এর বেশি মাত্রার শব্দ দূষণ হলে মানুষ বধির হয়ে যেতে পারে।
পানি দূষন: কচুরিপানা (Water hyacinth) পানি দূষণ কমাতে সহায়তা করে।
আরও দেখুন...